Our website use cookies to improve and personalize your experience. Our website may also include cookies from third parties like Google, Youtube. By using the website, you consent to the use of cookies. We have updated our Privacy Policy. Please click on the button to check our Privacy Policy.

ব্রহ্মপুত্র ধ্বংসে কতটা দায় আ’লীগের?

নদের কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও শুকনো। কোথাও আবার সরু খাল। যেখানে পানি আছে, সেখানে ‘বাংলা ড্রেজারে’ (অননুমোদিত খননযন্ত্র) বালু উঠছে। শুকনো জায়গায় নদের বুক খুঁড়ে তুলে নেওয়া হচ্ছে শত শত ট্রাক বালু। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে যত্রতত্র বড় বড় পুকুর ও ডোবার সৃষ্টি হয়েছে। নদের মাঝখানে ও তীরে বিশাল বালুর স্তূপ।

জামালপুর শহরের পুরাতন ফেরিঘাট এলাকার ব্রহ্মপুত্র সেতুর ওপরে দাঁড়ালে চোখে পড়ে এমন দৃশ্য। এককালের খরস্রোতা নদটির ক্ষতবিক্ষত দশা দেখে মনে হয়, ব্রহ্মপুত্র এখানে যেন নদ নয়, কেবলই বালুমহাল।

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদটি গাইবান্ধা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদের জামালপুর শহরের ছনকান্দা থেকে পিয়ারপুর পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দুটি বালুমহাল গত বছর ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। এরপর থেকে দিন-রাত বালু তোলা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ইজারার নামে অপরিকল্পিতভাবে বালু তুলে নদটি হত্যা করছেন বলে অভিযোগ পরিবেশবিদদের।

স্থানীয় বাসিন্দা, ইজারাদার ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যিনি ইজারা নেবেন, তাঁকেই বালু উত্তোলন করতে হবে, এমন শর্ত থাকলেও ইজারাদারের বদলে বালু তুলছেন ব্যবসায়ীরা। শর্তে আরও বলা আছে, বালুমহালে টোল আদায় করতে পারবেন না ইজারাদার। অথচ প্রকাশ্যেই টোল আদায় করা হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মো. শফিউর রহমান বলেন, ইজারাদারদের কিছু শর্ত দেওয়া আছে। সেভাবেই যাতে তাঁরা বালু তোলেন, সে জন্য সব সময় পর্যবেক্ষণ করা হয়। গত বছরের ইজারা মেয়াদ ১৩ এপ্রিল শেষ হবে। নতুন করে ইজারার দরপত্রপ্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। কিন্তু এখনো কার্যাদেশ দেওয়া হয়নি। অভিযোগগুলো সরেজমিনে দেখে তারপর কার্যাদেশ দেওয়া হবে।

গত বছর জেলা প্রশাসন সদর উপজেলায় নদের ২৭২ একর এলাকা দুটি বালুমহাল হিসেবে ইজারা দেয়। ছনকান্দা ও চর যথার্থপুর এলাকা নিয়ে গঠিত বালুমহালটি ৫২ লাখ টাকায় এক বছরের জন্য (বাংলা ১৪৩০ সন) ইজারা পায় মেসার্স হাজী এন্টারপ্রাইজ। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী জামালপুর পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. হাজী বাহার উদ্দিন। শরিফপুর, নান্দিনা, নরুন্দি ও পিয়ারপুর এলাকা নিয়ে গঠিত অপর বালুমহালটির ইজারা পায় মেসার্স নিধি এন্টারপ্রাইজ। এর স্বত্বাধিকারী মো. আলম আলী শরিফপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। তিনি মাত্র ২ লাখ টাকায় বালুমহাল ইজারা পেয়েছেন।

জামালপুর জেলা পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, আগে বালুদস্যুরা লুকিয়ে বালু তুলত। সেটা পরিমাণে খুব কম ছিল। এখন নামমাত্র টাকায় ইজারা নিয়ে অর্ধশত স্থান থেকে দিন-রাত বালু তোলা হচ্ছে। বালুদস্যুদের থাবায় ব্রহ্মপুত্র এখন আর নদ নেই, এক মরা খালে রূপ নিয়েছে। যেভাবে এবং যেসব যন্ত্র দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে, তা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের তৎপরতায় যাঁরা যুক্ত, তাঁরা নিশ্চয় প্রভাবশালী। যে কারণে স্থানীয় প্রশাসনের সামনে বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের নদ হত্যা চলতে পারছে।

মহাসড়কের উত্তর পাশ ঘেঁষে ব্রহ্মপুত্র বয়ে গেছে। সড়ক থেকে অর্ধশত রাস্তা নেমেছে নদের বুকে। এসব রাস্তা দিয়ে শত শত ট্রাক একদম নদের মধ্যে চলে যায়। ভেকুর (এক্সকাভেটর) মাধ্যমে ট্রাকে বালু ওঠানো হয়। এরপর ট্রাকগুলো চলে যায় শহরের বিভিন্ন স্থানে। এক্সকাভেটরের মাধ্যমে নদের পাড় কেটেও মাটি বিক্রি করা হচ্ছে।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, কিছুদিন আগেও মহাসড়ক থেকে অনেক দূরে ছিল নদের অবস্থান। অপরিকল্পিত বালু তোলায় নদ ভাঙতে ভাঙতে মহাসড়কের একদম কাছে চলে এসেছে।

বানারেরপাড় থেকে নান্দিনা পূর্ব বাজার পর্যন্ত নদটি একদম মহাসড়কঘেঁষা। সেখানে ভাসমান নৌকার মধ্যে বাংলা ড্রেজার বসিয়ে বালু তোলা হয়। পাইপের মাধ্যমে এসব বালু সড়কের সঙ্গে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। সেখানে থেকে ট্রাকে ভর্তি করে বিভিন্ন স্থানে বালু বিক্রি করা হচ্ছে। নদের তীরে দাঁড়ালে বাংলা ড্রেজারের বিকট শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যায়।

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০-এর ৫ ধারা অনুযায়ী, ‘নদীর তলদেশ থেকে মাটি বা বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রে যথাযথ ঢাল সংরক্ষণ সাপেক্ষে সুইং করে নদীর তলদেশ সুষম স্তরে খনন করা যায়, এরূপ ড্রেজার ব্যবহার করতে হবে।’ অবশ্য জেলা প্রশাসক বলছেন, এই আইন কেবল মাটি খননের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের জামালপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, নিয়ম অনুসারে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করে সুইং ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা উচিত। এই প্রক্রিয়ায় বালু তোলা হলে নদের ক্ষতি হবে না। অবৈধ বালু উত্তোলনের বিষয়ে জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।

বালুমহাল ইজারার শর্তের ১০ নম্বর ধারা অনুযায়ী, বালুমহাল অন্য কারও কাছে সাব-ইজারা দিতে পারবেন না ইজারাদার। অর্থাৎ যিনি ইজারা নেবেন, তাঁকেই বালু তুলে বিক্রি করতে হবে। কিন্তু দুটি বালুমহালেই ইজারাদারদের পরিবর্তে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বালু তুলছেন। ইজারার শর্তানুযায়ী, নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো উপায়ে বালুমহালে ইজারাদার টোল আদায় করতে পারবেন না। অথচ দীর্ঘদিন ধরে এক রকম প্রকাশ্যেই ট্রাকপ্রতি ২০০ টাকা টোল আদায় করছেন ইজারাদারেরা।

শরিফপুর, নান্দিনা, নরুন্দি ও পিয়ারপুর এলাকার বালুমহালের ইজারাদার আলম আলী নিজে বালু তোলেন না। তিনি বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত কোনো ঘাট নাই। ড্রেজার মেশিন নাই। যাঁরা বাপ-দাদার আমল থেকে বালুর ব্যবসা করেন, তাঁরাই বালু তোলেন এবং বিক্রি করেন। যেসব জায়গায় বালু তোলা হচ্ছে, সেসব জায়গায় আমার লোকজন আছে। গাড়ি গেলেই আমি টোল নিয়ে থাকি।’ ইজারার শর্ত ভাঙার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রশ্নটি সঠিক, শর্ত ভাঙার জন্য কয়েকবার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে আমার কোনো জায়গা নাই। তাই যাঁরা আগে ব্যবসা করতেন, তাঁরাই বালু তোলেন।’

ছনকান্দা ও চর যথার্থপুর বালুমহাল ইজারাদার বাহার উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ছনকান্দা এলাকার লোকজন বালু বিক্রি করেই চলে। তাই এলাকার লোকজনের কাছেই বালু ছেড়ে দিয়েছি। তাঁরাই বালু তুলে বিক্রি করেন। আমরা মূলত রাস্তায় টোল নিয়ে থাকি। বালু তুলি না। কিন্তু ইজারার শর্ত অনুযায়ী আমাদের বালু তোলার কথা ছিল। ডিসিসহ সব কর্মকর্তাই বিষয়গুলো জানেন।’
আমার ব্যক্তিগত কোনো ঘাট নাই। ড্রেজার মেশিন নাই। যাঁরা বাপ-দাদার আমল থেকে বালুর ব্যবসা করেন, তাঁরাই বালু তোলেন এবং বিক্রি করেন। যেসব জায়গায় বালু তোলা হচ্ছে, সেসব জায়গায় আমার লোকজন আছে। গাড়ি গেলেই আমি টোল নিয়ে থাকি।’ ইজারার শর্ত ভাঙার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রশ্নটি সঠিক, শর্ত ভাঙার জন্য কয়েকবার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে আমার কোনো জায়গা নাই। তাই যাঁরা আগে ব্যবসা করতেন, তাঁরাই বালু তোলেন।

নান্দিনা পশ্চিম বাজার অংশে নদ থেকে নৌকার মধ্যে ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে বালু তোলা হয়। এতে ওই অংশের পাকা ঘরবাড়িতে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। গত রোববার দেখা যায়, মো. আল আমিন, আবদুর রশিদ, আমিরুল ইসলাম, আনিছুর রহমান, মো. মাহবুব, আবদুস সোহরাব, মো. মাসুদ ও মো. মাজম মিয়ার বাড়ির মেঝে ও দেয়ালে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। মো. শাকিল মিয়া বলেন, ‘বালু তোলার কারণে ঘরবাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিছু বলতে গেলে, উল্টো আমাদের হুমকি দেওয়া হয়। শুধু এই এলাকা নয়, যেসব জায়গায় বালু তোলা হয়, সেসব এলাকায় বর্ষা মৌসুমে নদে ব্যাপক ভাঙনও দেখা দেয়।’

Related Posts