বাংলাদেশ এখন অনেক আধুনিক হয়েছে। ডিজিটাল হয়েছে। অজোপাড়াগাঁয়ের অনেক মুদিদোকানিকেও ল্যাপটপ চালাতে দেখা যায়। অনেক বাজারে ঘাটে, মোড়ে কফির দোকান হয়েছে। ফাস্টফুডের দোকান হয়েছে। লোকজন প্রচুর ইংরেজি ভাষা শিখছে। লোকজন বাংরেজি ভাষা ছাড়া কথাই বলছে না। গ্রামের বিয়ের অনুষ্ঠানেও রোস্ট পোলাও হচ্ছে। নারী নেতৃত্বে বিশ্বে বাংলাদেশের মতো অন্য কোনো দেশ আছে কি না জানা নেই। মার্গারেট থ্যাচার, মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী, চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা, অ্যাঞ্জেলা মারকেল, হিলারি, ইন্দিরা, বেনজির ইত্যাদি যার নামই বলি না কেন, কেউই বাংলাদেশের দুই নেত্রীর মতো এত দীর্ঘ সময় দেশ শাসন করেছেন বলে জানি না।
বাংলাদেশের বয়সের বেশির ভাগ সময় রাষ্ট্রশাসন করেছেন দুজন নারী। সবচেয়ে বেশি সময় বিরোধী দলের নেত্রীও ছিলেন তারাই। স্পিকার, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও নারীরা পালন করছেন। রাজনীতিতে বড় বড় পদও আছে তাদের। সংসদ উপনেতা। বিচারপতি, সামরিক কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়াও প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও আছেন। বড় বড় পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশকও আছেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এত কিছু থাকার পরও কিভাবে এই রাষ্ট্রে ক্রমাগতভাবে নারী-শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি পেতে পারে? গত ২ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকের একটি শিরোনাম ছিল, গত বছর ধর্ষণসহ নির্যাতনের শিকার তিন হাজার ৪৪০ নারী ও শিশু। মহিলা পরিষদের তথ্য। এই রিপোর্ট থেকে কয়েকটি বাক্য এখানে তুলে ধরছি, ২০২০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন উদ্বেগজনক ছিলো। ১২ মাসে মোট তিন হাজার ৪৪০ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সংগঠনের লিগ্যাল এইড সংরক্ষিত ১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে সংগঠনটি এই তথ্য জানায়। এত দীর্ঘ সময় একটা রাষ্ট্র নারীদের দিয়েই যদি শাসিত হয় তাহলে কিভাবে সেখানে নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি চরমভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে?
এ নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। আরেকটি ব্যাপার হলো, আমাদের দেশের দু’জন (পর্যায়ক্রমে) প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ নারীরা বেশির ভাগ বক্তৃতায় নারীর উন্নয়ন নিয়ে দু’চারটা কথা বলেই থাকেন। দেশের নারী আন্দোলনেও বিপুলসংখ্যক নেত্রী ও নারীকর্মী আছেন। তাদেরকে ঢাকার রাজপথে, প্রেস ক্লাবের সামনে, ডিআরইউর মধ্যে প্রায়ই নারীদের পক্ষের বিভিন্ন স্লোগানে দেখা যায়। মজার ব্যাপার, নারীরা তাদের জেন্ডারভিত্তিক যে কিছু শব্দ আছে সেটাও পরিবর্তন করেছেন। যেমন- সংসদে আগে নারী প্রধানমন্ত্রী এবং দলীয় প্রধানকে নেত্রী বলতেন। এখন নেতা বলেন! অথচ নেতা শব্দ পুরুষ জেন্ডারের জন্য ব্যবহৃত হওয়ার কথা। আগে কলেজ-ইউনিভার্সিটির নারী শিক্ষিকাদের (সিনিয়র) বাংলায় অধ্যাপিকা বলা হতো।
এখন নারী-পুরুষ উভয় লিঙ্গকে অধ্যাপক বলা হয়। শিক্ষক-শিক্ষিকা আলাদাভাবে ব্যবহৃত হতো। এখন উভয়কে শিক্ষক বলা হয়। এখন সরকারি অনেক নারী জেন্ডারের অফিসার পাবলিকের মুখ থেকে বা নিম্নপদের লোকদের মুখ থেকে স্যার ডাক শুনতে চান! অথচ স্যার পুরুষের জন্য। ম্যাডাম নারীর জন্য। নারী-পুরুষ উভয়েই মানুষ। নারী আমাদের মা। পুরুষ আমাদের বাবা। দুটি জেন্ডারের জন্য মেডিক্যাল সায়েন্সের অনেক কিছু আলাদা আলাদা। সামাজিক অনেক বিষয় ও অনেক কিছু আলাদা। এতে এটা প্রমাণিত নয় যে, নারীরা পুরুষের তুলনায় ছোট। এটা জেন্ডারগত বৈশিষ্ট্য। এসব কথা এখানে উল্লেখ করলাম এ জন্য যে, নারীবাদী নেত্রীরা এবং উচ্চক্ষমতাশালী নারীরা নারীদের মৌলিক নিরাপত্তাই আজ পর্যন্ত দিতে পারেননি। মাত্র কয়েকদিন পরই ৫০তম স্বাধীনতা দিবস পালন করবে বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকরা কি বঞ্চনা থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন? স্বাধীন বাংলাদেশের নারীরা কি নিরাপত্তায় আছেন? এমন প্রশ্ন আমাদের কাছে বারবার আসছে।
১৯৭১ সালের ৯ মাসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ হয়েছে তার অভিনয়চিত্র আমরা টিভিতে কম দেখছি না। যেভাবে অভিনয় করে সিনেমার অনেক নায়ক-নায়িকা রাষ্ট্রীয়ভাবে বড় বড় পুরস্কারও পাচ্ছেন। তাহলে কেন নারীরা আতঙ্কিত থাকবেন?
গত ৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ধর্ষণের অভিযোগ: পাঁচ বছরে মামলা ১৯ হাজার শিশু সুরক্ষায় সুনির্দিষ্ট আইনের তাগিদ।
এই প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ‘দেশে ধর্ষণের শিকার মোট শিশু-কিশোরীদের মধ্যে হত্যার শিকার হয় প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। যা সংখ্যায় ৮৬ শতাংশ। তবে সারা দেশের সব ঘটনা জানা যায় না। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রেই ঘটনার শিকার নারীর বয়স জানা যায় না। কিন্তু যাদের বয়স পাওয় গেছে সেখান থেকেই গত পাঁচ বছরে ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার নারীর সংখ্যা মোট চার হাজারের মতো। তবে ধর্ষণ নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের মতে, ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা হবে অনেক বেশি। পুলিশ সদর দফতরের হিসাবে, পাঁচ বছরে ধর্ষণের অভিযোগে ১৯ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। অর্থাৎ দিনে গড়ে ১১টি মামলা হচ্ছে।’ আমরা এমন ঘটনাও মাঝে মধ্যে মিডিয়াতে পাচ্ছি যে, খোদ পুলিশ হেফাজতেই নারী ধর্ষিত হচ্ছে। মেডিক্যালের মর্গে মৃত নারীকেও ধর্ষণ করা হচ্ছে।
আমরা এমনো খবর মাঝে মধ্যে পাচ্ছি যে, নারীর মাহরুম পুরুষও নারীকে ধর্ষণ করছে। অর্থাৎ কোনো কোনো কন্যাশিশুকে বা আরো বেশি বয়সের নারীকে তার বাবা, ভাই, মামা, চাচা ধর্ষণ করছে। সেটা শুনতেই যেন আকাশ ভেঙে পড়ে! কেন আমাদের সমাজের মানুষদের মধ্যে একটা অংশ এত বর্বর, বিকৃত চরিত্রের হলো? এই অসভ্যতা কিভাবে আমাদের সমাজে তৈরি হলো? সেটাও গবেষণার বিষয়। আমরা দাবি করছি, আমাদের দেশ অনেক অনেক উন্নত হয়েছে।
আমরা অনেক শিক্ষিত হয়েছি। অথচ গ্রাম, পৌর, সিটি সব এলাকায় এখনো ধুমছে যৌতুক চলছে। সরাসরি নামটা যৌতুক না হলেও কন্যার বাবাকে ফতুর করা হচ্ছে। অন্য দিকে নারীরা এত এত উচ্চশিক্ষিত হলেও নারী তার সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কে অন্ধকারে। বেশির ভাগ নারীই এখনো জানেন না, তার বাবার কতটুকু সম্পত্তি তিনি পাবেন। স্বামীর থেকে কত সম্পত্তি পাবেন। ফলে এখান থেকেও নারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা নারীদেরকে এ বিষয়ে সচেতন করছে না। এটা কি রাষ্ট্রের দায় নয়? চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী এলাকায় মেয়েদের বিয়ে দিতে বাবার বারোটা বেজে যায়। রমজান মাসে গাড়ি ভরে ইফতার পাঠিয়ে দিতে হয় জামাইয়ের বাড়িতে। কত শত রকম যে দেয়ার কালচার সেখানে আছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে যৌতুকটা ওপেন। সেখানের উচ্চ ডিগ্রিধারী অনেক লোকও যৌতুকের বিনিময়ে বিয়ে করে। এসব কিছুও নারী নির্যাতনের শামিল বলে আমি মনে করি। সুশাসন ছাড়া এসব বন্ধ করা সম্ভব নয়।