সবচেয়ে গুরুতর সমস্যাটি হচ্ছে ‘অধিকারের’। সম্পদ, পৈত্রিক প্রভাব অথবা রাজনৈতিক ক্ষমতার কারণে (শেষেরটি অন্যগুলোর তুলনায় বেশি কার্যকর) কিছু মানুষ মনে করেন, তাদের যা ইচ্ছা তাই করার অধিকার আছে। যেমন: অন্যদের অপমান করা, ছোট করা এবং প্রকাশ্যে বিষোদগার করা। বিষয়টা এমন— যত বেশি কুৎসিত আচরণ করবে, ততই যেন বলিষ্ঠ হয় তাদের পেশিশক্তির প্রদর্শন। আমরা দরিদ্র শিশুদের সঙ্গে যে আচরণ করি, তা এ ধরনের বৈষম্যের কুৎসিত চেহারাকে অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি বেদনাদায়কভাবে ফুটিয়ে তোলে।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার স্থানীয় পৌরসভা মেয়রের বিরুদ্ধে ৭ ও ১১ বছর বয়সী ২ শিশুকে নির্যাতন, মারধর ও হাত বেঁধে ২ কিলোমিটার পথ হাঁটানোর অভিযোগ উঠেছে। মেয়রের দাবি, ওই ২ শিশু একটি পরিত্যক্ত কারখানা থেকে কিছু পুরনো যন্ত্রপাতির জং ধরা নাট-বল্টু ‘চুরির চেষ্টা করছিল’। অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার অপেক্ষায় বেশ কিছুদিন ধরেই কারখানাটি উন্মুক্ত পড়ে আছে। ওই ২ শিশু সেখানে খেলতে গিয়ে কয়েকটি নাট-বল্টু হাতে তুলে নেয়। তারা হয়তো সেগুলো নিয়ে খেলতে চেয়েছিল। মেয়র দূর থেকে ঘটনাটি দেখতে পেয়ে রেগে যান এবং ওই শিশুদের মারধর ও নির্যাতন করেন।
এটা হঠাৎ রেগে গিয়ে নিজের ক্ষোভ প্রকাশের ঘটনা নয়। তিনি সেখানে তার ক্ষমতার প্রদর্শন করেছেন। ওই ২ শিশুকে তিনি হাত বেঁধে স্থানীয় বাজারে সবার সামনে ২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ঘুরিয়েছেন। সেই সময় ওই শিশুদের অভিভাবক ও পরিবারের সদস্যরা মেয়রের কাছে কাকুতি-মিনতি করে ক্ষমা চান। শেষ পর্যন্ত ওই শিশুদের ক্ষমা করা হয়, কিন্তু তার আগে তাদের মাথার চুল কেটে দিয়ে জনসমক্ষে চূড়ান্তভাবে অপমান করা হয়। এই শাস্তির কারণ হলো, তাদের ছোট চুল দেখে যেন মানুষ তাদের চোর হিসেবে চিনতে পারে এবং বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা, বিদ্রূপ ও মৌখিক হয়রানির সুযোগ থাকে, যেন তাদের শাস্তিকে আরও দীর্ঘায়িত করা যায়।
প্রথমত, এটি সামাজিক শ্রেণি ও অবস্থানের বিষয়। আমরা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি— ৭ ও ১১ বছর বয়সী ওই ২ শিশু যদি ওই মেয়রের মতো একই সামাজিক অবস্থান, সম্পদ অথবা রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী কোনো পরিবারের সন্তান হতো, তাহলে তিনি কখনোই তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারতেন না।
দ্বিতীয় কারণটিও ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত। মেয়র নিশ্চিত ছিলেন, ওই ২ শিশুর অভিভাবক বা পরিবারের সদস্য পুলিশের কাছে যাওয়ার সাহস পাবেন না। কারণ, সেখানেও হয়তো মেয়রের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তা ছাড়া, তাদের এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সংস্থার সঙ্গে কোনো ধরনের ‘যোগাযোগ’ নেই, যারা মেয়রকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারবে।
বাকি রইলো শুধু গণমাধ্যম। আমরা স্থানীয় সাংবাদিকদের সাধুবাদ জানাই, কারণ তারা সর্বান্তকরণে ওই ৭ ও ১১ বছর বয়সী ২ শিশুর ওপর হওয়া সহিংসতার বিষয়টি গণমাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
ওই শিশুদের ওপর মেয়রের এই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সুনির্দিষ্ট প্রভাব সম্পর্কে এখনই, এমনকি অদূর ভবিষ্যতেও জানা সম্ভব নয়। মারধর, নির্যাতন, হাত বেঁধে রাখা এবং মহল্লার সবার সামনে ঘোরানোর কারণে তাদের ভেতরে যে কষ্ট তৈরি হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে দীর্ঘস্থায়ী হবে। হাত বেঁধে মহল্লায় সবার সামনে ঘোরানোর কারণে তারা যে কষ্ট পেলো, তা মারধরের কারণে পাওয়া শারীরিক কষ্টের চেয়ে অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং আজীবন তাদের মনে এই ঘটনার ক্ষত থেকে যাবে।
বাবা-মা, পরিবার ও খেলার সঙ্গীদের সামনে এ ধরনের অপমান তাদের মনে গভীর বেদনা ও লজ্জার কারণ হবে। এই কারণে তাদের মাঝে কখনোই হয়তো স্বাভাবিক আত্মসম্মানবোধের জন্ম হবে না। এ ধরনের আতঙ্কজনক অভিজ্ঞতা শিশুর আত্মসম্মানবোধের স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। নিঃসন্দেহে আমাদের আড়াইহাজার উপজেলার মেয়র শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধের জগত থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন যে, এ ঘটনার গুরুত্ব বোঝা তো দূরের কথা, আমরা কী নিয়ে আলোচনা করছি, সেটাও হয়তো তিনি বোঝেন না।
আমি বিস্মিত যে, এই মেয়র কীভাবে এবং কার কাছে জবাবদিহি করবেন? এই সংবাদ প্রকাশের পর তিনি লুকিয়ে আছেন এবং অপেক্ষা করছেন, কখন এই বিষয় নিয়ে আলোচনা কমবে এবং গণমাধ্যম এ নিয়ে আগ্রহ হারাবে।
এমন কোনো কাঠামো বা প্রক্রিয়া কি আছে, যার মাধ্যমে ওই ঘটনার তদন্ত হবে, স্থানীয়দের কাছ থেকে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা হবে এবং অভিযুক্ত মেয়রকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে? এমন কোনো কর্তৃপক্ষ কি আছে, যার কাছে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকরা ন্যায়বিচারের জন্য যেতে পারবেন?