একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিবার ‘অপরাধে’ নোয়াখালীর সুবর্ণচরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার নারীর বিচার পাইতে পাইতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অতিক্রম করিয়াছে। এই রায়ও আসিয়াছে মাত্র নিম্ন আদালত হইতে। আসামিপক্ষের আইনজীবী উচ্চ আদালতে লড়াই করিবার ঘোষণা ইতোমধ্যে দিয়াছেন। চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি লইয়া নাগরিক সমাজ, সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের নজরদারি সত্ত্বেও নিম্ন আদালত পার হইতে পাঁচ বৎসর লাগিয়াছে; সাধারণ মামলাগুলির পরিস্থিতি সহজেই অনুমেয়। সকল ‘চাঞ্চল্যকর’ মামলাও সমান ‘সৌভাগ্য’ লাভ করে না। ২০২০ সালে সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সহিত ঘুরিতে গিয়া ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হইয়াছিলেন এক নারী। দেশব্যাপী নিন্দা ও প্রতিবাদের মুখে উচ্চ আদালতের নির্দেশে বিচারিক তদন্ত কমিটি গঠিত হইয়াছিল। কিন্তু গত তিন বৎসরে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণই শুরু হয় নাই। ইহার মধ্যেই রবিবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় অভিন্ন পন্থায় স্বামীকে রশিবদ্ধ করিয়া স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হইয়াছে।
অবস্থাদৃষ্টে এই আশঙ্কা অমূলক হইতে পারে না, সংশ্লিষ্ট মামলাগুলির বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতাই ধর্ষণের অঘটন নিয়ন্ত্রণের অন্তরায় হইয়া।
পুলিশ সদরদপ্তরকে উদ্ধৃত করিয়া বলা হইয়াছে, দেশের বিভিন্ন থানায় প্রায় সাড়ে ২৭ সহস্র ধর্ষণের মামলা হইয়াছে। ঐ সময়ের মধ্যে শুধু ঢাকা মহানগরেই ৩ সহস্রাধিক ধর্ষণের মামলা হইলেও সাজাপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা মাত্র ২৪! ধর্ষণের মামলার এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে– নারীর জন্য চরম অবমাননাকর অপরাধটির কতটা বাড়বাড়ন্ত ঘটিয়াছে এবং সাজাপ্রাপ্তির হার কতটা নগণ্য। বলা বাহুল্য, নারী নির্যাতনের অনেক মামলাই থানা কিংবা আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। আমরা মনে করি, ধর্ষণ মামলাগুলির দ্রুত বিচার সম্ভব হইলে নির্যাতনকারী বেপরোয়া হইয়া উঠিত না।
আমরা জানি, যেই কোনো মামলায় দীর্ঘসূত্রতা হয়রানিকর ও হতাশাজনক। কিন্তু ধর্ষণ-সংক্রান্ত মামলার দীর্ঘসূত্রতার আর্থসামাজিক ক্ষতি ও ক্ষত আরও গভীরে। কারণ এই সুযোগে অনেক ক্ষেত্রেই আসামি নিম্ন আদালতে দায়ের হওয়া মামলার বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ জানাইয়া উচ্চ আদালত হইতে জামিনে বাহির হইয়া যায়। ধর্ষণের ঘটনার অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাদীর তুলনায় বিবাদী অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। ফলে জামিনে বাহির হইয়া তাহারা বেআইনি প্রভাব খাটাইয়া ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি ও তাঁহার পরিবারেরই জীবন-জীবিকা জেরবার করিয়াছে– এইরূপ নজির কম নাই। সামাজিক চাপ কিংবা অর্থনৈতিক টানাপোড়েনেও ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবার ও স্বজন অনেক ক্ষেত্রে মামলার দীর্ঘ প্রক্রিয়া হইতে নিষ্ক্রিয় হইয়া নিষ্কৃতি পাইয়া থাকে। মামলার তদন্ত ও অভিযোগ প্রক্রিয়ায় পুলিশ ও আইনজীবীদের ইচ্ছা বা অনচ্ছিাকৃত ঔদাসীন্যও মামলাকে হালকা করিয়া ফেলিতে পারে।
স্বীকার্য, দুই দফা সংশোধনের পর ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের যেই শাস্তি বিধান করা হইয়াছে, উহা সহজ নহে। কিন্তু খোদ বিচার প্রক্রিয়াই যদি দীর্ঘসূত্রতায় হাবুডুবু খাইতে থাকে, তাহা হইলে কঠিন শাস্তি কী কাজে লাগিবে? সমকালের প্রতিবেদনে উদ্ধৃত সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নার সহিত আমরা সহমত– প্রশাসনযন্ত্র চাহিলেই ধর্ষণ মামলার দীর্ঘসূত্রতা কাটাইয়া ওঠা সম্ভব। সরকারের সেই সদিচ্ছা প্রার্থনীয়।