বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে শেখ হাসিনা একজন “স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে স্বীকৃত”; “[তিনি] তোষামোদকারীদের দ্বারা নিজেকে পরিবেষ্টিত রাখেন, যারা তাকে খুশি করতে সারাক্ষণ তাই বলে যা তিনি শুনতে চান। এবং এরাও [হাসিনার মতোই] ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য মরিয়া,” বলেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এশিয়া বিভাগের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ব্র্যাড এ্যাডামস। এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত এই পদে দায়িত্বরত ছিলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, “২০০৯ থেকে আমরা যা দেখেছি তা হলো শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সম্পূর্ণ কুক্ষিগত করে ফেলেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র আর আওয়ামী লীগ নামের এই রাজনৈতিক দলটি তাদের কাছে সমার্থক, তারা মনে করে যে তাদের দল এবং রাষ্ট্রের মাঝে কোনও পার্থক্য নেই। এবং তাদের বিশ্বাস এই রাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকাটা তাদের ঐতিহাসিক অধিকার”। নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক ডেভিড বার্গম্যানের সঙ্গে একটি ভিডিও সাক্ষাতকারে এ মন্তব্য করেন তিনি।
সাক্ষাতকারে আওয়ামী লীগের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাসের কঠোর সমালোচনা করেন এ্যাডামস। একের পর এক বিচারবহির্ভুত হত্যা, গুম, বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, পাতানো নির্বাচন এবং রোহিঙ্গা শরনার্থী নিয়ে সরকারের ভূমিকা তার সমালোচনায় উঠে আসে। একই সঙ্গে সম্প্রতি মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত বাহিনী র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) নিয়েও কথা বলেন তিনি। ২০০৪ সালে এই এলিট পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) তীব্র সমালোচনা করেন এ্যাডামস।
তিনি বলেন, “যতদুর বোঝা যায়, বিএনপির বাজে মানবাধিকার রেকর্ডের জন্য যেসমস্ত নেতাকর্মীরা দায়ী, তারা এখনও দলে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছেন। বিএনপিকে এটা ঠিক করতে হবে।”
বিশেষ করে, যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিষয়ে তিনি বলেন, “[বিএনপিতে] এখনও একই নেতৃত্ব আছে। [বিএনপি] যদি ক্ষমতায় আসে তবে তারেক নেপথ্যে থেকে দলে কাজ করবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। জানিনা, হয়তো বাংলাদেশে কোনওভাবে ফিরেও আসতে পারেন তিনি। যদিও অতীতের কর্মকাণ্ড নিয়ে তার অনুতাপ আছে এমন কিছু আভাস তিনি দিয়েছেন, তবে সেই অনুতাপের বিষয়টিতে সততার ছিঁটেফোঁটাও আছে, এমনটা বিশ্বাস করার কোনও কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না।”
২০ বছর এইচআরডব্লিউর এশিয়া বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে শেখ হাসিনার সঙ্গে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয় ব্র্যাড এ্যাডামসের, যা নিয়ে তিনি নেত্র নিউজের সাক্ষাতকারে কথা বলেছেন। ২০০৮ সালে বিরোধী দলের নেতা থাকাকালীন গৃহবন্দি ছিলেন শেখ হাসিনা। আর সেসময় তাকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য এইচআরডব্লিউর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন হাসিনা।
সেসময় সামরিক বাহিনী-নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল ক্ষমতায়, যারা হাসিনাকে গৃহবন্দি করে রেখেছিল। এ্যাডামস বলেন, “লন্ডনে শেখ হাসিনা, নিজে ব্যক্তিগতভাবে আমার সামনে উপস্থিত থেকে আমাকে ধন্যবাদ জানান, হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা তার জীবন বাঁচিয়েছি’, যদিও তার এই বক্তব্য ঠিক না ভুল, জানি না। সেসময় শেখ হাসিনা দাবি করেছিলেন যে বন্দি থাকা অবস্থায় তাকে বিষ প্রয়োগ করা হচ্ছিল এবং সেসময় যারা তার মুক্তির দাবি জানিয়েছে আমরা ছিলাম তাদের মধ্যে অন্যতম এবং এর বদৌলতেই তিনি শেষ পর্যন্ত মুক্ত হন।”
সেসময় হাসিনার কৃতজ্ঞতা-প্রাপ্ত এ্যাডামস এখন মনে করছেন যে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বিচারবহির্ভুত হত্যা এবং গুমের বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত এবং সব জেনেও এ বিষয়ে কিছু করছেন না, “এমন কোন [কূটনীতিক নেই] যিনি জানেন না যে হাসিনা জেনে শুনে পুরো বিষয়টার তত্তাবধান করছেন; এগুলো তার অগোচরে ঘটছে না, তিনি এ বিষয়ে জানেন এবং এর জন্য কোনও দায়িত্ব নিতেও তিনি রাজি নন।”
“যদি হাসিনা এসব বন্ধ করতে চাইতেন তবে তাতে প্রায় সম্পূর্ণই সফল হতেন। কিছু নিয়ন্ত্রণহীন লোকজন হয়তো থাকতো, তবুও সেক্ষেত্রে তিনি সুষ্ঠূ বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু এমন কিছুই তিনি করেননি। কাজেই এসব ব্যক্তিরা যা করার করেই চলেছে এবং হাসিনা এমন ভান করছেন যেন এসব ঘটনা ঘটছেই না কিংবা তিনি এসমস্ত ঘটতে দিচ্ছেন।”
সম্প্রতি জারি হওয়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য “অত্যন্ত কঠোর বার্তা” বলে মনে করছেন এ্যাডামস এবং এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু “জীবন রক্ষা” পেয়েছে বলে বিশ্বাস করেন তিনি, “হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অন্যান্য সংগঠন বাংলাদেশের আরও বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাবে কেননা [তার পক্ষে] যথেষ্ট স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।” এবং তিনি আরও যোগ করেন যে তার প্রত্যাশা যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কিছু দেশ [এসকল ব্যক্তির ওপর] “তাদের নিজস্ব নিষেধাজ্ঞা জারি করবে।”
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করার উদ্দেশ্যে এইচআরডব্লিউ থেকে অব্যাহতি নেওয়া এ্যাডামস বলেন, নিষেধাজ্ঞাগুলো প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন লবিং ফার্মের পিছনে টাকা নষ্ট করছে। তিনি বলেন যে “এই সমস্যা থেকে মুক্ত হবার” একমাত্র উপায় হলো, “যে কাজগুলো হাসিনা সরকার করছে তা বন্ধ করা”, বেনজীর আহমেদকে দেশের পুলিশ প্রধানের পদ থেকে অপসারণ করা, এবং “অন্যান্য নেতৃস্থানীয় যারা অভিযুক্ত হয়েছেন তাদের অপসারণ করা” এবং “আইনের শাসন মেনে চলতে নিবেদিত এমন ব্যক্তিদের পদাসীন করা।”
সাক্ষাতকারটিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, বাকস্বাধীনতা, সুষ্ঠু ও স্বাধীন নির্বাচন, এবং রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়েও নেত্র নিউজের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
আওয়ামী লীগ
বিরোধী দলে থাকাকালীন করা প্রতিজ্ঞাগুলো কিভাবে আওয়ামী লীগ ভঙ্গ করেছে তা নিয়েও কথা বলেন এ্যাডামস, “সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালীন র্যাব এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অন্যান্য বিভিন্ন অংশ, যারা একই ধরনের বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সরব ছিল। সেসময় আমরা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের অনেক নেতৃবৃন্দর সঙ্গে যখনই সাক্ষাৎ করেছি তারা সবসময় বলেছে যে তারা র্যাবকে বিলুপ্ত করবে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর উপর তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। সেসময় তারা নিজেদের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের, বাকস্বাধীনতার পক্ষের দল হিসেবেও দাবি করেছিল। তারা বলেছিল, “আমরা উদার গণতন্ত্রপন্থী (লিবারাল ডেমোক্র্যাট) এবং আমরা দেশে নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবো এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যেন না ঘটতে পারে তা নিশ্চিত করবো।”
আওয়ামী লীগের বর্তমান চেহারা
“[কিন্তু] ২০০৯ থেকে আমরা যা দেখেছি তা হলো শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সম্পূর্ণ কুক্ষিগত করে ফেলেছে। তারা মনে করে যে তাদের দল এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মাঝে কোনও পার্থক্য নেই। এবং তাদের বিশ্বাস এই রাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকাটা তাদের ঐতিহাসিক অধিকার। এবং যখন একজন রাষ্ট্রপ্রধান মনে করেন যে সেই রাষ্ট্রের জনগণের জনমতের ভিত্তিতে নয় বরং অধিকারের বলে তিনি ক্ষমতায় আছেন এবং এই জোর করে টিকে থাকাকে তারা সবার বিরুদ্ধে একটা অস্তিত্বের লড়াইয়ে পরিণত করে, তখন সেই রাষ্ট্রে শোষণ-নিষ্পেষণ নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায়। এবং তা-ই হয়েছে। নিজেদের পক্ষে আওয়ামী লীগের যুক্তি হলো, রাজনৈতিক স্বার্থে নয় বরং ‘আমরা যা করার তা দেশের স্বার্থে করছি।’ কাজেই আমি মনে করি তারা যে পথে এগোচ্ছে এখন তা খুবই ভয়ানক।”
“বহু বছর হলো সঠিকভাবে সব দলের অংশগ্রহণে দেশে কোনও নির্বাচন হয় না; সামনেও হবে কিনা তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন নিশ্চিত করার কোনও সদিচ্ছা আওয়ামী লীগের আদৌ আছে কিনা তাও অনিশ্চিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত এবং তা ফেরত আসারও কোনও সম্ভাবনা নেই, ফলে নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান রাজনৈতিক অধিকার চর্চার সুযোগ থাকবে কিনা তা এখন খুবই অনিশ্চিত। যারা এসব বিষয় নিয়ে দেশে কাজ করেন তারা আমাদের কাছে খুব পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন যে মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের অবস্থা যেদিকে এগোচ্ছে তা নিয়ে তারা ভীষণ নিরাশ, এবং বহির্বিশ্বের সরকারগুলোও প্রচন্ড নিরাশ। হাসিনা এখন স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে স্বীকৃত। তিনি তোষামোদকারী দ্বারা নিজেকে পরিবেষ্টিত রাখেন। এই ব্যক্তিরা তাকে খুশি করার জন্য সারাক্ষণ তাই বলে যা তিনি শুনতে চান। এবং এরাও [হাসিনার মতোই] ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য মরিয়া।”
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিষয়ে
এ্যাডামস আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) নিয়েও কথা বলেন। ২০১০ সাল থেকে এই ট্রাইব্যুনালে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটনের জন্য অভিযুক্তদের বিচার শুরু হয়।
“আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সব তথ্য বিবেচনা করেছি, বিচারকদের সাক্ষাতকার নিয়েছি, সরকারি আইনজীবিদের সাক্ষাতকার নিয়েছি। এর ভিত্তিতে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে এই ট্রাইব্যুনালে সঠিক আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এবং প্রমাণের ভিত্তিতে বিচার কাজ হচ্ছেনা। কাজেই এই বিচারপ্রক্রিয়া ন্যায্য হচ্ছে না।”
“আমি নিজে চিফ প্রসেকিউটরের (প্রধান সরকারি কৌশুলী) সঙ্গে দেখা করেছি একাধিকবার। এবং তার সঙ্গে কথা বলে আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। ন্যায় বিচার হবে কিনা এটা তার চিন্তার বিষয়ই ছিল না। তাদের তদন্ত করার পদ্ধতি কেমন, কীভাবে তারা তথ্য সংগ্রহ করেছেন, কীভাবে সেগুলো যাচাই করেছেন, কেন তারা একটা বিচারে প্রধান দলিল হিসেবে ৩০ বছর আগের এমন একজনের শোনা কথাকে ব্যবহার করছেন যিনি অভিযোগকৃত হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থলে উপস্থিতও ছিলেন না — এসব বিষয়ের কোনও ব্যাখ্যাই তিনি আমাকে দিতে পারেন নি। এটা তো আসলে যাচ্ছেতাই একটা অবস্থা। যে ব্যক্তি ৩০ বছর বা তারও বেশি সময় আগে উপস্থিতও ছিলো না এবং এখন বলছে, ‘এই ঘটনা ঘটেছে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত কারণ আমাকে একজন বলেছে এমন ঘটেছিল’, এবং এই কথার ভিত্তিতে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে। এটা তো কোন সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া হতে পারে না।”
“এখানে এমন একটিও স্বাধীন সংগঠন কাজ করেছে বলে আমার জানা নেই যারা এই ট্রাইব্যুনালকে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং এর প্রক্রিয়াকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এর ওপর প্রজেক্ট করেছে। অনেক দাতা রাষ্ট্র এতে অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছে কারণ তারা দায়বদ্ধতার বিষয়টা নিশ্চিত হোক তা চেয়েছে। দেখুন, আমরা, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, বিশ্বজুড়ে যুদ্ধাপরাধ ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে চাই। এটা আমাদের একটি প্রধান কাজ। আমরা এর পক্ষে, কিন্তু তা হতে হবে যথাযথ পদ্ধতির মাধ্যমে। এবং এমন কোনও স্বাধীন সংগঠন, মানে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন সংগঠন, আছে বলে আমি জানি না, যারা বাংলাদেশের আইসিটি ট্রাইব্যুনালের এই বিচারগুলোকে ন্যায্য বিবেচনা করেছে।”