প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাবশালী বোন শেখ রেহানা বিনা ভাড়ায় বসবাস করেন উত্তর লন্ডনের একটি বাড়িতে। কাগজে কলমে এই বাড়ির মালিক আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান, যিনি বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। তার পিতা সালমান ফজলুর রহমান প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ভাইস চেয়ারম্যান এবং একইসঙ্গে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী-পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। পিতা-পুত্র উভয়েই এই সংস্থানের সঙ্গে জড়িত।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বেক্সিমকো। রেহানা বিনা ভাড়ায় যেই বাড়িতে থাকছেন — এই ধরনের বাড়ির মাসপ্রতি ভাড়া যুক্তরাজ্যের এস্টেট এজেন্টদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৪,০০০ পাউন্ড বা ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। আর ১১ বছর আগেই এই বাড়িটি কেনা হয়েছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫.৪ কোটি টাকা দিয়ে।
দুর্নীতি-বিরোধী বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই গোপন বন্দোবস্তে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। তবে আইনজীবী ও প্রতিনিধির মাধ্যমে দেয়া বক্তব্যে শায়ান রহমান, তার পিতা সালমান রহমান ও শেখ রেহানা বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
শেখ রেহানা লন্ডনে যেই বাড়িতে থাকেন, তার প্রকৃত মালিকানা কার তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ধোঁয়াশা ছিল। ২০১১ সালে বাড়িটি কেনা হয় লেডিবার্ড প্রোপার্টিজ নামে একটি অফশোর প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে।
গোপনীয়তা ও কর সংক্রান্ত সুযোগসুবিধার জন্য বিশ্বের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু দ্বীপ রাষ্ট্র বা অঞ্চলের কুখ্যাতি রয়েছে। অফশোর শব্দটির ব্যাকরণগত বিভিন্ন অর্থ থাকলেও, ওই ধরণের কুখ্যাত দ্বীপ রাষ্ট্র বা অঞ্চলকেই অফশোর বোঝানো হয়।
ঠিক এমনই একটি অফশোর “ট্যাক্স হ্যাভেন” হিসেবে পরিচিত দ্বীপ হলো “আইল অফ ম্যান” নামের স্বায়ত্বশাসিত ব্রিটিশ উপনিবেশ, যেটি যুক্তরাজ্যের মূল ভূখন্ডের গা ঘেঁষে অবস্থিত। এখানেই নিবন্ধিত হয়েছে লেডিবার্ড প্রোপার্টিজ।
যুক্তরাজ্যের কোম্পানি নিবন্ধকে সংরক্ষিত নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, লেডিবার্ড প্রোপার্টিজের মালিকানায় রয়েছে অনেকগুলো খোলস বা শেল কোম্পানি। ওই শেল কোম্পানির মালিকানায় রয়েছে আরও অনেকগুলো শেল কোম্পানি। এভাবে খোলসের পর খোলস দিয়ে গোপন রাখা হয়েছে লেডিবার্ড প্রোপার্টিজের আসল মালিকের নাম ও পরিচয়।
তবে নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এই লেডিবার্ড প্রোপার্টিজ, অর্থাৎ শেখ রেহানা যেই বাড়িতে থাকেন, তার প্রকৃত মালিক হলেন শায়ান ফজলুর রহমান।
বেক্সিমকোর নিজস্ব ওয়েবসাইট ও অন্যান্য নথিপত্রে তাকে বেক্সিমকোর পরিচালনা পর্ষদের উপদেষ্টা বলা হয়েছে। তবে বিভিন্ন সময় তিনি নিজেকে গ্রুপের পরিচালক পরিচয় দিয়েছেন। বেক্সিমকোর বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকও তিনি। তিন বছর আগে তাকে গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির একটি সংবাদ-বিজ্ঞপ্তিতে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।
শায়ান রহমান হলেন সালমান ফজলুর রহমানের ছেলে। বেক্সিমকোর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান ভাইস-প্রেসিডেন্ট সালমান এফ রহমান সরকারি দলের একজন সংসদ সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা। শেখ রেহানাকে বিনা ভাড়ায় লন্ডনের বাড়িটিতে থাকতে দেয়ার যেই বন্দোবস্ত, তাতে সালমান ও শায়ান রহমান উভয়েরই সম্পৃক্ততা রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি-বিরোধী চর্চা বিষয়ক অধ্যাপক রবার্ট ব্যারিংটন নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে বলেন, “এটি শেল (খোলস) কোম্পানির মাধ্যমে মালিকানা লুকিয়ে রাখার বেশ পরিচিত একটা পদ্ধতি এবং এই পদ্ধতি প্রায়ই লন্ডনে কাজে লাগানো হয়।”
তিনি আরও বলেন, “এখানে যেই প্রশ্নের উত্তর নেই, তা হলো এক পক্ষকে সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে অন্য পক্ষ অনৈতিক উপায়ে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে কিনা। কোনো সন্দেহ যেন না থাকে, সেজন্য এটি প্রত্যাশা করাই যুক্তিযুক্ত হবে যে, ওই প্রতিষ্ঠান ও সরকারের মধ্যে এখন পর্যন্ত যত ধরণের লেনদেন হয়েছে, সেগুলোর সকল তথ্য সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দেয়া হোক।”
“স্বার্থের দ্বন্দ্ব”
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বেক্সিমকো গ্রুপ যেসব বিশেষ সুবিধা ভোগ করেছে বলে জানা যায় তার মধ্যে রয়েছে সরকারি ব্যাংকে বেক্সিমকোর বিশাল অংকের অপরিশোধিত ঋণের পুনঃতফসিলিকরণ ও কোভিড-১৯ টিকার একমাত্র পরিবেশক হওয়ার সুযোগ পাওয়া।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সালমান এফ রহমানকে তার ব্যক্তিগত বেসরকারি খাত উন্নয়ন বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে, ২০১৮ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর হাসিনা সালমান এফ রহমানকে বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টার আনুষ্ঠানিক পদে নিয়োগ দেন।
বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের উপহার বা উপঢৌকন গ্রহণ করার বিষয়ে বিধিমালা রয়েছে। এই বিধিমালার অধীনে সরকারি কর্মচারিরা এমন কোনো উপহার গ্রহণ করতে পারবেন না যার কারণে “উপহারদাতার প্রতি তাদের কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়।” এছাড়াও বাংলাদেশের একটি আইন রয়েছে যার অধীনে মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তারা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্যের অধিক কোনো উপহার পেলে তা সরকারি তোষাখানায় জমা দিতে বাধ্য থাকবেন।
সরকারি কর্মচারিদের জন্য এধরণের আচরণবিধি থাকলেও, সংসদ সদস্য ও তাদের নিকটবর্তী পারিবারিক সদস্যরা যেন স্বার্থের দ্বন্দ্ব (কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট) ঘটে এমন আর্থিক বা অন্যান্য সুবিধা নিতে না পারেন তা নিশ্চিত করার কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই, যা অন্য অনেক দেশে রয়েছে।
স্বার্থের দ্বন্দ্ব যেন না থাকে তা নিশ্চিত করা সুশাসনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। অরগানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) তাদের টুলকিটে স্বার্থের দ্বন্দ্ব এড়াবার বিষয়ে উল্লেখ করেছে, “স্বার্থের দ্বন্দ্ব চিহ্নিত করা ও দূর করা করা সুশাসন ও গণপ্রতিষ্ঠানের উপর বিশ্বাস সমুন্নত রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
রেহানাকে বিনা ভাড়ায় বাড়িতে থাকতে দেয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বেক্সিমকো গ্রুপের মধ্যকার সম্পর্ক আসলে কেমন তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিশেষত, যেসব সরকারি সিদ্ধান্তে বেক্সিমকো লাভবান হয়েছে তার সাথে প্রধানমন্ত্রীর বোনকে দেয়া এই উপহারের যোগসূত্র রয়েছে কিনা সেই বিষয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়।