২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট যখন ক্ষমতায় আসে, তার আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় ছিল। চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের তেমন উল্লেখযোগ্য কোন নেতাকর্মীর উপর নির্যাতন চালিয়েছিল মর্মে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে, সেসময় দেশের কয়েকটি স্থানে সংখ্যালঘু তথা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের উপর হামলা হয়েছিল। পরবর্তীতে অবশ্য জানা গিয়েছিল যে, এইসব ঘটনার অধিকাংশই ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং অনেকক্ষেত্রে ব্যক্তিগত রেষারেষির বিষয়কেও সংখ্যালঘু নির্যাতন হিসেবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচার করা হয়েছিল।
ঘটনা যাই ঘটুক না কেন, একথা স্বীকার করতেই হবে, সেসময়ে সেই সামান্য কয়েকটি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাকে আওয়ামী লীগ বেশ ফুলে ফাপিয়ে প্রচার করতে সক্ষম হয়েছিল। দেশতো বটেই এমনকি বিদেশী অনেক সংস্থাও বিশ্বাস করেছিল যে, চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে হিন্দুদের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। বিএনপির সাথে ইসলামিক দল জামায়াতের জোট হওয়ায় এবং জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতা সরকারের মন্ত্রী হওয়ায় আন্তর্জাতিক মহল মোটামুটি বিশ্বাস করেছিল যে ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল থেকেই হিন্দু নির্যাতনের মত ঘটনাগুলোকে মদদ দেয়া হয়েছে। শাহরিয়ার কবিরের মত আওয়ামী দালালেরা সেই সময় নানা ধরনের শর্ট ফিল্ম ও ডকুমেন্টারী নির্মাণ করে এসব ঘটনাকে বিশ্বের দরবারে নেতিবাচকভাবে হাইলাইটও করেছিল।
দুর্ভাগ্য বিএনপির, দুর্ভাগ্য জামায়াতের আর দুর্ভাগ্য দেশবাসীরও। আওয়ামী লীগ বিতর্কিত নির্বাচন করে টানা তৃতীয়বারের মত ক্ষমতায় এসে যখন বর্বরতা আর পৈশাচিকতার জঘন্য নজির স্থাপন করে যাচ্ছে তখনও সেই সব সত্য ঘটনাগুলোকে সর্বমহলে বিরোধী দল তুলে ধরতে পারছেনা।
আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীরা চোখে রঙ্গিন চশমা পড়ে ঘুরছেন। তারা দেশকে উন্নত দেশ বলে ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন। একজন মন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ নাকি এখন লস এ্যাঞ্জেলেস হয়ে গেছে। অন্যদিকে আরেকমন্ত্রী এক ডিগ্রী এগিয়ে বলেছেন, কয়েক বছর পর নাকি আমেরিকা থেকেই লোকজন শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করতে আসবে। আল্লাহ এই সব দালাল ও দলকানা লোকদেরকে হেদায়েত নসীব করুন। এর চেয়ে বেশী কিছু আর বলারও নাই।
কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে বাংলাদেশের অবস্থা এখন ভয়াবহ। অন্যসব সংকটের কথা বাদ দিয়ে গেলেও এবারের বিতর্কিত নির্বাচনে নোংরাভাবে বিজয় হাইজ্যাক করার পর সরকার ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষকলীগসহ আওয়ামী লীগের অংগ সংগঠনের নেতাকর্মীরা যেভাবে নারী নির্যাতন ও ধর্ষনের উৎসব শুরু করেছে, তাতে আওয়ামী লীগের কি হবে জানিনা, তবে আমাদেরই মাথা লজ্জ্বায় হেট হয়ে যায়। নির্বাচনের পর থেকে আজ অবধি সারা দেশে নারী-শিশু ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতন আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে আজ নারী ও শিশুর ইজ্জত-আবরুর কোন নিরাপত্তা নেই।
নির্বাচনের পরের দিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচরে একটি গ্রামে একজন গৃহবধুকে তার স্বামীর সামনেই গন ধর্ষন করা হয়। তার অপরাধ ছিল তিনি বিরোধী দল তথা ধানের শীষের পক্ষে ভোট প্রদান করেছেন। এর ঠিক এক মাস পর গত ১লা ফেব্রুয়ারী রাতে সেই একই এলাকায় অর্থাৎ সুবর্ণচরের পূর্বচরবাটা ইউনিয়নে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত এক ছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। দেশে নারী-শিশু-কিশোরী অবাধে ধর্ষিতা হচ্ছে। প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তরা নারী-শিশু-কিশোরীকে ধর্ষণ করছে।
তদন্তে দেখা যায় সরকারী দলের লম্পট দুর্বৃত্তরা প্রশাসনের ছত্র ছায়ায় অবাধে ধর্ষণ ও হত্যার মত নৃশংস ঘটনা একের পর এক ঘটিয়ে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ এসব দেখেও না দেখার ভান করছে। ফলে ধর্ষকরা আরো উৎসাহিত হচ্ছে। তারা ধর্ষিতাদের অভিভাবকদের মামলা তুলে নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে এবং নাজেহাল করছে। ফলে নারী-শিশু-কিশোরী ধর্ষণ ও নির্যাতন মহামারী আকার ধারণ করেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা গিয়েছে যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ সরকারী দলের ধর্ষণকারীদের সাহায্য-সহযোগিতা করছে এবং ধর্ষকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা আমলে না নিয়ে ধামা-চাপা দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, গত ২০১৮ সালে যৌন সহিংসতায় সারা দেশে ৪২ জন নারী ও শিশু নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ২৮৪ জন। গত জানুয়ারী মাসের ৩৩ দিনে ৪১টি ধর্ষণ ও ধর্ষণ অপচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। তাদের ২৯ জনই শিশু ও কিশোরী। বাস্তবে দেশে নারী-শিশু-কিশোরী ধর্ষণের যে সব ঘটনা ঘটছে তার সামান্য অংশই মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে। বেশীর ভাগ ঘটনাই অজানা থেকে যাচ্ছে।
নারী-শিশু-কিশোরী ধর্ষণকারী দুর্বৃত্তদের বিচার না হওয়ার কারণেই নারী, শিশু-কিশোরী ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই যাচ্ছে। এ সব বন্ধ করতে হলে ধর্ষণকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। আওয়ামী যেসব ক্যাডাররা এসব অপকর্মের সাথে যুক্ত হয়েছে তাদের প্রত্যেককে প্রকাশ্যে শাস্তি দিতে হবে। পুলিশ ও প্রশাসনের যে কর্মকর্তারা এসব অপরাধের ব্যপারে নির্বিকার ভুমিকা পালন করছে, মদদ দিচ্ছে তাদেরকেও চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ইসলামপন্থী দল ও ব্যক্তিবর্গদের হেয় করা বন্ধ করতে হবে। ইসলামী দলগুলোকে অবাধে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। ওয়াজ ও ধর্মীয় আলোচনাগুলোর প্রসার ঘটাতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে ধর্মীয় ও নৈতিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে এগুলো অধ্যায়ন বাধ্যতামুলক করতে হবে। কেননা এটাই দিবালোকের মত সত্য, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা ও মোটিভেশন ছাড়া এই ধরনের জঘন্য অপকর্মকে কোনভাবেই রোধ করা যাবেনা। আর যদি ধর্ষণ আর নারী নির্যাতন এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগের তথাকথিত উন্নয়নের চাঁপাবাজি করে জনগনকে নিয়ন্ত্রনে রাখাও সম্ভব হবেনা।